
আমার নাম মো:সেলিম ।পাগল মানুষ ।মাজারে মাজারে থাকি ।ছবি: মনিরুল আলম
তার সারা শরীরে একটা চট জড়ানো । বুকে ঝোলানো আজমির শরীফের ছবি । মহাখালির ফুটপাত ধরে একরকম ছুটেই চলছেন ।কথা বলার জন্য ডাক দিতেই-বাবা,আমার ছবি তুলবেন না ।
আপনি গলায় আজমির শরীফের ছবি ঝুলিয়ে রাখতে পারেন ,আর আমি ছবি তুললে কি হয়?
না বাবা,অনেকে ফটো তুইলা উল্টাপাল্টা করে ,এতে আমাগো খেতি হয়।
আপনার এই পাগল জীবনের ইতিহাস জানতে চাই?
আমার নাম মো:সেলিম ।পাগল মানুষ ।মাজারে মাজারে থাকি ।খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি,গরিবে নেওয়াজ,শাহ আলী আর মনে করেন হযরত গোলাপ শাহ বাবার মাজারে পাগল মানুষ হিসাবে পইড়া থাকি ।মনে করেন পাগল মানুষের তো কোনো ভিসা নাই,যে যা দেয় তা-ই খাই,বিষ দিলে বিষ খাই,পানি দিলে পানি খাই-১০ বছর ধইরা এমনে চলতাছি।
আপনার ঢাকায় ভিসা লাগল কবে?
আমি মনে করেন ,বড়র থেইকা ছোড হইছি ঢাকায় ।আমার ভাদাইম্যা বাপ যখন আমাগো ফালাইয়া থুইয়া গেলোগা ,হেয় পরে মায়ের লগে ঢাকায় চইলা আইছি ।আমাগো দেশের বাড়ি ভোলা লালমোহন থানা চরফ্যাশন- গ্রাম গজারিয়া ।বাবা,আমি অনেক গরিবের সন্তান ।উপরে আল্লাহ আছেন সৃষ্টিকতা ।আমার বড় ভাই হেইডাও একটা ভাদাইম্যা ।আমার বড় বইনরে ঢাকা আইনা টেকার লোভে বেইচা ফালাইল ।
আপনারা কয় ভাই কয় বোন ?
আমরা তিন ভাই তিন বোন আছি – হের পরে মনে করেন দশ জনে যেডা কইবো হেইডা হইবনা – তো মনে করেন দশ জনে যেডা কইছে হেডা হইছে ।আমার বইনেরে বাসা বাড়ির কামে দিয়া বেইচা ফালাইছে ।বড় বইনেরে ছুটাইতে গিয়া আর চিকিৎসা করাইতে গিয়া বাড়িঘরে যা আছিল তা বেইচা ফালাইল আমার মায় ।আমরা হইলাম পথের ফকির ।
কাম করতে করতে বেইনের দুইডা হাত পইচা গেছিল । আমার বুড়া মায়রে বাপে দেয়না খাওন,ভাইয়ে দেয়না খাওন – মনের দুঃখে বাড়ির থন বাহির হইয়া আইছি ।তবে বাবা আমি মায়ের দোয়া লইয়াই মাজারে মাজারে ঘুরি,তিন বইনেরে বিয়া দিছি ,ভোলায় যা আছিল সব বেইচা আমি আর আমার মা- এখন নারায়নগন্জের ফতুল্লায় এক খুপরিতে থাকি ।
আপনিতো মাজারে মাজারে থাকেন কইলেনে তো মায়ের লগে আবার কেমনে থাকেন ?
আমি মাঝে মাঝে দেখতে যাই ।কোন মায়-ই চায় না তার সন্তানরে ফালাইয়া দিতে । আমিও আমার মায়েরে ঠিকই দেহি ।
এখন কিভাবে আপনি আর অপনার মা চলেন ?
বাবা,আল্লায় চালায় । বাবা আমি দশ জনের কাছে হাত বাড়াইয়া খাই,কারোটা মাইরা কাইটা খাইনা ।
আপনি কি বিয়া করছেন?
আমি বাবা, বিয়া করি নাই ।আমার লগে বাবা মিছা কথা পাইবেন না – আমি সত্যই বিয়া করি নাই ।
আপনের গ্রামের কথা কিছু মনে আছে?
আমার এক বিশাল নদী আছে ,ওস্তাদ আপনি দেখলে ডরাইয়া যাইবেন ।ভোলা লালমোহন সাগরের নাম শোনেন নাই, এইহানকার নদী তো কিছুই না । আমার নদী এই পার থেইকা ওই পার কিছুই দেহন যায়না । আমার বাপের লগে ছোড বেলায় বড় বড় চউ মাছ ধরতে যাইতাম । নদীতে যহন ভাটা পড়ত হেই সময় এক পদের গোটা আছে “হুরমাইল”কয় – ভাটা হুকাই গেলে এক পদের গাতা হয়,হেই গাতায় হুরমাইল ছিটাই দিলে মাছ গাতার থন ফাল মাইরা উঠত । হেই মাছ আমার বাপে আর আমি বাজারে বিক্রি করতাম – আনজুরহাট,বাবুরহাটে । মঙ্গলবারে আর রবিবারে হাটে মাছ বিক্রি বেশী হইত ।
এক কাল দুই কাল যাইতে বাবায় একদিন হালায়া থুইয়া গেছেগা । বাপে নাই আমরা ছোড ছোড । আমার পড়লাম কষ্টে – খাওনের কষ্ট , পিনদনের কষ্ট । পরালেহা করার সুযোগ পাইনাই । পরালেহা করলে কি আইজ পাগলের মতো ঘুরতাম । সলিট কথা হোনেন – ভাই খাইতে চাইতাম ভাত পাইতাম না , খিদার জ্বালায় কানতাম-মানুষের ঘরের থাইকা ফেন খাইয়া পেট বাচাঁইছি । বাবা,খাওয়ার কষ্ট যে কি কষ্ট , তা আপনারা বুঝবেন না ।
মাজারে ঘুইরা কি পাইলেন ?
বাবা,পাইছি ঠিকই , কিন্তুক রাখতে পারি নাই,তয় মানুষ চিনছি – মাজারে যে কত পদের মানুষ আসে ।
দেশের বাড়িতে কি যান ?
বাবা , দেশের বাড়ি কউ ছাড়ে , জন্মের টান । আমার গ্রামের দক্ষিণে সাগর অঞ্চল , কোনো বাড়িঘর নাই – মনে করেন ঝড় তুফানে ঘরবাড়ি ভাইঙ্গা নিলেও আবার কষ্ট কইরা বাড়িঘর কইরা লয় আমার অঞ্চলের মানুষ । আমি মনে করেন সুবিধা হইলে মায়রে লইয়া ঠিকই বাড়িত যামুগা ….
এই ছালা পইরা কে আপনারে ঘুরতে কইছে ?
এইটা আমার গুরুর আদেশ । মনে করেন , একেক পাগলের একেক ড্রেস – আমার ড্রেস ছালা ।
মনিরুল আলম
১৫,নভেম্বর, ২০১৬
পুরান ঢাকা
Like this:
Like লোড হচ্ছে...